জুম চাষ কাকে বলে? কোথায় হয়? জুম চাষ কেন ও কীভাবে করা হয়?

জুম চাষ হল একটি ঐতিহাসিক চাষ পদ্ধতি বা কৃষি পদ্ধতি। এই চাষ পদ্ধতির ইতিহাস কৃষির ইতিহাসের মতই পুরনো। প্রত্নতত্ত্ব বিদগণ প্রমাণ করেছেন যে, নব্য প্রস্তর যুগে আনুমানিক ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুম চাষের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। এই জুম চাষ পদ্ধতির মাধ্যমেই হান্টিং-গেদারিং ( নৃবিজ্ঞানের প্রাচীন যুগ ) সামাজ ব্যবস্থা থেকে ফুড প্রডিউসার বা খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ ভিত্তিক নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আজকে আমরা জুম চাষ কী ? জুম চাষ কাকে বলে ? এটি হয় কোথায় ? জুম চাষ কেন করা হয় ? কীভাবে জুম চাষ করা হয় ? ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

জুম চাষ কি

জুম চাষ একটি পরিভাষাগত শব্দ। ‘জুম চাষ’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল – Shifting cultivation. Shifting ইংরেজি শব্দটির অর্থ হল – পরিবর্তন করা, স্থানান্তর করা, স্থান পরিবর্তন করা। আর Cultivation শব্দের অর্থ হল – চাষাবাদ বা কৃষি। অর্থাৎ, জুম চাষ এর অর্থ দাঁড়ায় – স্থান পরিবর্তন এর মাধ্যমে চাষাবাদ। অনেক ক্ষেত্রে জুম এর ইংলিশ – ‘Jhum’ লেখা হয়। এজন্যই, জুম চাষ কে অনেকে ঝুম চাষ ও বলে।

জুম চাষ কাকে বলে ?

৯ম – ১০ম শ্রেণির ভূগোল ও পরিবেশ বইয়ের একাদশ অধ্যায়ে জুম চাষের উল্লেখ রয়েছে। জুম চাষ হল পাহাড়ি অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচলিত এবং ঐতিহ্যবাহী বিশেষ এক ধরণের চাষাবাদ পদ্ধতি। পাহাড়ের ঢালে বনভূমি বা পাহাড়ি জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে কয়েক বছর বা মৌসুম চাষাবাদ করার ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়, উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য পাহাড়ের ঐ স্থানে চাষাবাদ বন্ধ রেখে পাহাড়ের অন্য স্থান এর জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করাই হল জুম চাষ। জুম চাষীদেরকে জুমিয়া বলা হয়।

অর্থাৎ, পাহাড়ের বনভূমি বা পাহাড়ি জঙ্গল পরিষ্কার করে, আগুন জ্বালিয়ে গাছপালা পুড়িয়ে সেখানে চাষাবাদ করাকেই জুম চাষ বলে। যখন একটি প্লট বা জমি অনুর্বর হয়ে যায় তখন এই প্লট পরিবর্তন করে পাহাড়ের অন্যত্র নতুন জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে চাষাবাদ শুরু করা হয়। সমতল ভূমিতে ফসল পরিবর্তনের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু পাহাড়ে ফসল পরিবর্তন না করে জমি পরিবর্তন করার মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির যে প্রক্রিয়ায় কৃষিকাজ করা হয় সেটাই হল জুম চাষ বা Shifting Cultivation। যেহেতু, কিছু সময় চাষাবাদের পরে জমি শিফট বা পরিবর্তন করা হয় এজন্য একে শিফটিং কাল্টিভেশন বলা হয়।

জুম চাষ হয় কোথায়

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এ পদ্ধতির চাষাবাদ করা হয়। তবে জুম চাষ মূলত দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ী ও অর্ধ-অরণ্য অঞ্চলে হয়। বিশেষ করে নিম্নলিখিত দেশগুলোতে জনপ্রিয়:

বাংলাদেশ: দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে, বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জেলায় জুম চাষ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম এর প্রায় শতকরা ৯০% পাহাড়িই জুম চাষ করে। এছাড়াও বাংলাদেশের নেত্রকোনার গারো পাহাড়ে এবং সিলেট মৌলভিবাজারে খাসিয়া পাহাড়ে গারো ও খাসিয়ারা এ ধরণের চাষাবাদ করত।

কিন্তু, এই পাহাড়ি বনাঞ্চলগুলো রিজার্ভ ফরেস্ট বা সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার ফলে এখানে জুম চাষ বিলুপ্ত হয়েছে। যদিও খাসিয়ারা পানজুম (জুম চাষ পদ্ধতিতে পান চাষ) করে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর ভূমি এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়।

ভারত: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যেমন মেঘালয়, আসাম এবং নাগাল্যান্ডে এটি একটি প্রচলিত পদ্ধতি। এখানে আদিবাসী জনগণ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।

নেপাল: নেপালের কিছু পাহাড়ী অঞ্চলে, বিশেষ করে হিমালয়ের পাদদেশে, এ পদ্ধতির চাষাবাদ করা হয়।

মিয়ানমার: মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে কাচিন রাজ্যে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি পদ্ধতি।

ভিয়েতনাম: ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলীয় পাহাড়ী এলাকাগুলোতে জুম চাষের প্রচলন দেখা যায়।

এই অঞ্চলে জুম চাষ কৃষকদের জন্য শুধু খাদ্যের উৎস নয়। বরং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও একটি অংশ। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জুম চাষ কেন করা হয়?

জুম চাষ করার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:

পাহাড়ী অঞ্চলে উপযুক্ততা অন্যতম একটি কারণ। এ ধরণের চাষ পদ্ধতি মূলত পাহাড়ী এবং অগভীর জমিতে করা হয়, যেখানে সাধারণ কৃষি পদ্ধতি কার্যকর নয়। এই পদ্ধতিতে কৃষকরা স্থানীয় জলবায়ু, মাটি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করেন।

আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যও অনেকে এটি করে থাকেন। এর মাধ্যমে কৃষকরা মূলত লাভজনক ফসল উৎপাদন করেন। যা তাদের আয়ের একটি প্রধান উৎস। জুম চাষের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কারণ সামাজিক ঐতিহ্য। অনেক জনগণের মধ্যে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি। এটি তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ এবং সামাজিক জীবনের অঙ্গ।

জুম চাষ কীভাবে করা হয়?

জুম চাষের প্রক্রিয়া সাধারণত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

জমির প্রস্তুতি: বাংলাদেশে পৌষ-মাঘ মাসে জুম চাষের জন্য জুমিয়ারা একটুকরো জঙ্গল নির্বাচন করে। তারপর সেখানের সব গাছ-পালা, বাঁশ কেটে ফেলে পরিষ্কার করে। কাটার পর সেগুলো রোদে শুকায় চৈত্র মাস পর্যন্ত। সাধারণত চৈত্র ও বৈশাখ মাসের শুরুতে ঐ শুকনো গাছ পালা আগুনে পুড়িয়ে চাই করে ফেলা হয়। গাছ পালার সঙ্গে উপরের মাটিও ঝলসে যায়। ছাই ও ঝলসে যাওয়া মাটি উর্বর হয়।

বপন: জমি পরিষ্কার হওয়ার পরে, চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষের অনুষ্ঠানের পর সাধারণত ফসল বোনার উৎসব শুরু হয়। বৃষ্টি হলে জমি ভিজে নরম হয়। তখন, কৃষকরা ফসলের বীজ বপন করেন। সাধারণত, ধান, কাউন, ভুট্টা, তিল, আদা, হলুদ, তুলা এবং কুমড়ো জাতীয় ফসল বেশি চাষ করা হয়।

রক্ষণাবেক্ষণ: ফসলের বৃদ্ধি পর্যায়ে, কৃষকরা নিয়মিত দেখাশোনা করেন, জল দেওয়া, আগাছা তোলা এবং প্রয়োজন হলে কীটনাশক প্রয়োগ করেন।

ফসল কাটার সময়: ফসল পরিপক্ক হলে, কৃষকরা এটি কেটে নেন এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণ করেন।

জলবায়ুতে জুম চাষের ক্ষতিকর প্রভাব

মাটির অবক্ষয়পাহাড় ধ্বস: জুম চাষে মাটি কাটার ফলে মাটির উর্বরা শক্তি কমে যায়। বারবার মাটি চাষ করা হলে তার উপরের স্তর ক্ষয় হয় এবং মাটির গঠনও বদলে যায়। এছাড়াও পাহাড় ধ্বস এর মত ঘটনা ঘটতে পারে।

জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: জুম চাষের ফলে বনভূমি কমে যায়। যার ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য বা ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়। অন্যান্য পশু পাখির আবাস ধ্বংস হতে পারে, যা স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কার্বন নিঃসরণ: বনাঞ্চল কাটা হলে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এটি গ্রীণহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। যেটি বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ এর মাধ্যমে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিতে পারে। যার ফলে বাংলাদেশ এর মত উপকূলীয় দেশের ভূমি পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

বিবিধ-ব্লগ এর সাথেই থাকুন। ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করুন। কোন ভুল ত্রুটি বা পরামর্শ থাকলে জানাতে পারেন।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *