ঘরে বসে প্যাকিং এর কাজ — এক নতুন প্রতারণার জাল

বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজের সুযোগ সন্ধান করা সাধারণ ব্যাপার। বিশেষ করে গ্রামীণ ও শহরের নিম্নআয়ের নারী-পুরুষেরা “ঘরে বসে কাজ” এর সন্ধান করে থাকেন। তবে দুর্ভাগ্য যে ঘরে বসে প্যাকিং অথবা অনলাইন এ আয় নামে যে বিজ্ঞাপন পায়, তার অধিকাংশই প্রতারণা। সম্প্রতি বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা ও গ্রামীণ নারীদের টার্গেট করে কলম প্যাকেজিং কাজ অথবা ঘরে বসে প্যাকিং এর কাজ দেওয়ার নামকরে একটি কোম্পানির ভঙ্গিতে প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়েছে। এই প্রতারণা সাধারণত “বিনা ঝামেলায় পেন প্যাকিং করে আয়” বা “ঘরে বসে প্যাকিং এর কাজ” শিরোনামে সরল মনা, গ্রামীণ, দরিদ্র নারীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

নিচে দেওয়া হল এই প্রতারণার ধরণ, ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা, মোবাইল নম্বর ও ঠিকানার উদাহরণ, এবং প্রতারণা থেকে বাঁচার উপায় ও করণীয়:


প্রতারণার ধরণ ও কাজের প্রলোভন

সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন

তারা ফেসবুক ও অন্যান্য গ্রুপে “ঘরে বসে কলম প্যাকেজিং” এর কাজ এর ভিডিও পোস্ট করে। যেখানে প্রতিদিন বা মাসে একটি নির্দিষ্ট আয় হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়।
উদাহরণস্বরূপ — “মাসে ১৬,০০০ টাকা ইনকাম,” “প্রতি মাসে ১০,০০০ পিস কলম প্যাকিং করতে হবে” ইত্যাদি। (Facebook)

পজিটিভ রিভিউ ও স্ক্রিনশট

সেই ফেসবুক পেজ এবং পোস্টে নিজেদের বা পরিচিতদের মাধ্যমে ভুয়া রিভিউ ও স্ক্রিনশট আপলোড করে একটি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করে।

রেজিস্ট্রেশন চার্জ

প্রথম ধাপে বলা হয় রেজিস্ট্রেশন করার জন্য ৩০০/৫০০/৮৫০ টাকা পাঠাতে হবে। তারপর নিচের মত একটি ম্যাসেজ পাঠায় – “আসসালামু আলাইকুম প্রিয় গ্রাহক আপনার জব রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার ভিতরে ১০ হাজার পিস কলম এগারোটা বক্স সহকারে আপনার লোকেশনে পৌঁছে যাবে প্রতিটি বক্স এ ডেলিভারি চার্জ ২৪০ টাকা ধরবে টোটাল ২৬৪৯ টাকা আসবে আপনার পার্সেল রেডেক্স করিয়া তে অনলাইন কোড কন্ডিশন এ পাঠানো হচ্ছে। রেডেক্স এর গাড়ি আপনার জেলাই গিয়ে দারাবে সেখান থেকে নামিয়ে আপনার বাসায় নিয়ে যাবে ডেলিভারি লোকে দের অবশ্য বিকাশ এ পেমেন্ট করে পার্সেল এর কোড নিয়ে তাদের জানাবে আসা করি আপনি কলম গুলো রিসিভ করবেন আর ডেলিভারির টাকা টা আমরা আপনার মাসিক বেতন এর সাথে এড করে দিয়ে দেওয়া হবে ধন্যবাদ।”

অগ্রিম জমা

পরের দিন এই চক্রের মহিলা সদস্য কল করে বলে ডেলিভারি ম্যান আপনার জেলায় গিয়েছে এখন টাকা পরিশোধ করলে মাল আপনার ঠিকানায় নিয়ে যাবে, দ্রুত টাকা পাঠান। এখন টাকা পাঠিয়ে একটি ওটিপি কনফার্ম করতে হবে আর নাহলে আপনার প্রডাক্ট যাবে না।

OTP ফাঁকি

চাকরি প্রত্যাশী নারী টাকা পাঠালে একটা উদ্ভট রকমের ওটিপি পাঠায়, (Atb.198999.*)। ভুক্তভোগী যখন শুধু ৬ ডিজিট এর কোড টি বলে তখন বলে আপনি ওটিপি ভুল বলার কারণে পুনরায় টাকা পাঠাতে হবে, এবার টাকা পাঠালে আপনার আগের টাকা আপনার এই নাম্বারে ব্যাক পাঠানো হবে। এভাবে হারানো টাকার মায়ায় আবার টাকা পাঠান ভুক্তভুগিরা। তারপর একসময় বুঝতে পারেন অথবা প্রতারকরাই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

পুলিশের সাজানো ভয়ভীতি

অধিক টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর তারাই আবার ভিক্টিমকে পুলিশের মতো নম্বর (আইপি কল এর মাধ্যমে) থেকে হুমকি দেয়। যাতে আইনগত ব্যবস্থা না নেয়। ফোন করে বলে, “আপনি আইনি ব্যবস্থা নিলে এটা করা হবে, ওটা করবো ইত্যাদি ভয় দেখায়।”

এই প্রক্রিয়ায় একাধিক পর্যায়ে টাকা আদায় করে প্রতারকরা। অনেক বেকার ও সরল বিশ্বাসী নারী-পুরুষ এই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছেন।

প্রতারক চক্রের সাধারণ কিছু শিরোনাম যেগুলো তারা ব্যবহার করছে – এগুলো থেকে সাবধান থাকুন।

  • ঘরে বসে প্যাকিং এর কাজ
  • পেন প্যাকিং এর কাজ বাংলাদেশ
  • কলম প্যাকেজিং করে আয় করুন
  • নারী উদ্যক্তা সহায়তা

উদাহরণ মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা

প্রকাশিত অভিযোগে বলা হয়েছে:

  • মোবাইল নাম্বার: ০১৮৩৩৭৯৫৭৮৬, ০১৯৬৮৫৮৬৭৯১ (বিকাশ নাম্বার) (gramerkagoj.com)
  • অন্য মোবাইল: ০১৮৭৪০৬৭৭১৫ (রেজিস্ট্রেশন নাম্বার) (gramerkagoj.com)
  • ভুক্তভোগীর ঠিকানা: খোলাডাঙ্গা, গাজীর বাজার এলাকা, যশোর জেলার ভাড়া বাড়ি (gramerkagoj.com)

উৎস: যে নম্বর ও ঠিকানাগুলি এখানে দেওয়া হয়েছে, সেগুলি অভিযোগ ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পাওয়া; এই তথ্য পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যম থেকে সংগৃহীত হয়েছে।


2. এক ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা

মাহমুদাআক্তার লিজা (২১), গাজীর বাজার, খোলাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা, এমন এক সরল বিশ্বাসী ব্যক্তি যিনি এ প্রতারণার শিকার হন। অভিযোগে বলা হয়েছে:

  • ২৬ এপ্রিল সকালে একটি ইমো আইডি থেকে কল দেওয়া হয়, “কলম কোম্পানিতে কাজ দেবেন” বলে।
  • ৭৪০৬৭৭১৫ নম্বর দেওয়া হয় রেজিস্ট্রেশনের জন্য। প্রথমে ৮৫০ টাকা নেওয়া হয়। পরে আরও ৩ হাজার টাকা দাবি করা হয়।
  • পরে বিকাশ থেকে ২,৫০০ টাকা পাঠানো হয়, কিন্তু কাজ বা পণ্য কখনো পাঠানো হয়নি।
  • এরপর পুলিশ সেজে হুমকি দেওয়া হয়, “নকল কলম পাচার হয়েছে” বলবার পর ৩০,০০০ টাকা দাবি করা হয়।
  • সন্দেহ হওয়ায় লিজা থানায় অভিযোগ করেন। (gramerkagoj.com)

লিজা তার ক্ষতি কম হলেও চাইছেন প্রতারক চক্রকে ধরে শাস্তি প্রদান করা হোক, যাতে অন্য কেউ এ ফাঁদে না পড়েন।

ঘরে বসে পেন প্যাকিং এর কাজ এর নামে অনলাইন প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন আরেকজন তরুণী

বিলকিছ (ছদ্মনাম) নামের এক তরুণী আমাদের জানান তিনি এভাবে ৭৯৪৭ টাকা প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন। উপরে বর্ণিত মডেলেই তাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয় – যশোর জেলার একজন মহিলা (01344776241) নম্বর থেকে নারী কল করে তাকে কাজের প্রুফ দেখায় এবং নিম্নের বিকাশ নম্বর (01346961205 – এই বিকাশ একাউন্ট এর মালিক MST. JOLY BEGUM) এ টাকা নেয়। প্রথমে রেজিস্ট্রেশন ফি, পরে ডেলিভারি ফি এর নাম করে ৩ বার ২৬৪৯ টাকা নেয়। প্রথম বার ও টি পি নেওয়ার জন্য টাকা পাঠালে এই নম্বর থেকে (0134477624) উদ্ভট ও টি পি পাঠায়, যেটি সঠিক বললেও বলে ভুল হয়েছে। আবার ও টি পি নিতে টাকা পাঠান আগের টাকা ব্যাক চলে যাবে। এভাবে বার বার টাকা পাঠাতে বলে।

এই তরুণী থানায় জিডি করেছেন যেটি এখন প্রক্রিয়াধীন আছে। তার অল্প অর্থ হলেও আর কেও যেন এভাবে প্রতারণার স্বীকার না হন এজন্য আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি প্রমাণ হিসেবে আমাদের কাছে নম্বর গুলো দিয়েছেন। আমরা কথা বলে সত্যতা পাই এবং তিনি আমাদের টাকা পাঠানোর স্ক্রিন শট ও শেয়ার করেছেন। নিম্নে এগুলো যুক্ত করা হলো।

4. কলম প্যকেজিং এর কাজ – প্রতারণা থেকে বাঁচার উপায়

নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারেন:

  1. কোনো কাজে আগে টাকা দিতে হবে — সন্দেহ করুন
    বৈধ কাজ কখনোই অগ্রিম টাকা দাবী করবে না।
  2. OTP কখনো শেয়ার করবেন না
    ব্যাংক, মোবাইল সেবা, আর কোনো প্রতিষ্ঠানই কখনো OTP চান না পণ্য দেওয়ার আগে।
  3. ওটিপি-তে অস্বাভাবিক চিহ্ন থাকলে সন্দেহ করুন
    যদি OTP-তে *, . বা অস্বাভাবিক চিহ্ন থাকে, তাতেই বুঝবেন—এটি জাল। কেননা, ওটিপি হবে ৬ ডিজিট এর কোড।
  4. কর্মসংস্থানের প্রতিষ্ঠান যাচাই করুন
    প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, ঠিকানা, ফোন নম্বর খুঁজে দেখুন।
  5. সস্তা ইনকাম এর প্রলোভনে পা বাড়াবেন না
    মনে রাখুন অর্থ আয় সহজ কাজ নয়। আর অর্থ কেও আপনাকে এতো সহজে কেন দিবে…!
  6. পরামর্শ ও জনসচেতনতা ছড়িয়ে দিন
    পরিবার-বন্ধু ও আশপাশের মানুষকে এই প্রতারণা সম্পর্কে জানান, সচেতন করুন। প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। অন্যথায়, তারা সুযোগ পেয়ে যাবে।

5. যদি প্রতারিত হন: করণীয়

  1. যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করুন
    মোবাইলের স্ক্রিনশট, লেনদেনের রসিদ, চ্যাট লগ, নম্বর ইত্যাদি সংরক্ষণ করুন।
  2. থানায় অভিযোগ দিন
    সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি (জেনারেল ডায়রি) বা এফআইআর দায়ের করুন।
  3. সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট / ডিইউসি-তে যোগাযোগ করুন
    থানা যদি ইলেকট্রনিক অপরাধ বিভাগ না থাকে, সাইবার ক্রাইম ইউনিটে বিষয়টি তুলে ধরুন।
  4. ব্যাংকে অভিযোগ করুন
    আপনার ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্স সেবা প্রদানকারীর কারিগরি সাপোর্টে জানিয়ে দিন এবং অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করুন।
  5. আইনি সাহায্য নিন
    একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিন, প্রয়োজনে মামলা দায়ের করুন।
  6. সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ নিন
    সামাজিক মাধ্যমে বা স্থানীয় কমিউনিটিতে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন, যাতে অন্যরা সতর্ক হতে পারে।

6. প্রশ্নোত্তর (FAQ)

Q1: এই প্রতারণাগুলি কি শুধুই গ্রামীণ অঞ্চলে হয়?
A: না, শহর ও গ্রামীণ — দুই জায়গাতেই ঘটতে পারে। তবে গ্রামীণ এলাকায় কম প্রযুক্তি সচেতনতার কারণে বেশি শিকার হয়।

Q2: যদি আমি ইতিমধ্যে OTP দিয়ে দেই, তাহলে কি করণীয়?
A: দ্রুত ব্যাংক ও মোবাইল সেবা প্রদানকারীকে জানাবেন, হিসাব ব্লক বা লেনদেন রিভার্স করার অনুরোধ করবেন।

Q3: প্রতারক যদি পুলিশের নাম ধরে ভয় দেখায়, কি করবেন?
A: পুলিশের অফিসিয়াল নম্বর দিয়ে সত্যতা যাচাই করুন। কোনো কথা শুনবেন না যতক্ষণ না নিশ্চিত হবেন।

Q4: আমার নাম, ঠিকানা ও নম্বর দিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে, আমি কি দায়ী?
A: আপনি দায়ী না হলেও, আইনের চোখে আপনিই ক্রিমিনাল বা অপরাধী। এজন্য সচেতন থাকুন।

Q5: সরকারি কোনো হেল্পলাইন বা রিটার্ন পদ্ধতি আছে কি?
A: সাইবার অপরাধ বিভাগ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থা (জাতীয়) কিছু হেল্পলাইন চালায়। স্থানীয় থানার সাইবার ইউনিট ও বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার উইং-এ যোগাযোগ করুন।

Q6: এই ধরনের প্রতারণা ভবিষ্যতে বন্ধ করা সম্ভব হবে?
A: সম্ভব, যদি প্রযুক্তি সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ ও জনসাধারণের সচেতন পদক্ষেপ নেয়া হয়।


7. উপসংহার

“ঘরে বসে প্যাকিং এর কাজ” নামে এই প্রতারণার চক্র নির্দিষ্টভাবে নির্ভরশীল, সরল বিশ্বাসী গ্রামীণ ও নিম্নআয়ের নারীদের টার্গেট করে। প্রতারকরা সামাজিক আন্দোলন, দক্ষ চিত্রপ্রচার ও ভয় দেখানোর পথ অবলম্বন করে তাদের ফাঁদে ফেলে।

এই প্রতারণা রুখতে আমাদের সবার দায়িত্ব:

  • তথ্য যাচাই করা
  • OTP সচেতন ব্যবহার
  • প্রলোভন এড়িয়ে চলা
  • প্রতারণার শিকার হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া

আপনি যদি হয়েছেন ভুক্তভোগী– একা লড়বেন না; আইনগত সহায়তা নিন। এছাড়া, এই তথ্য আপনার পরিবার, বন্ধু ও পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করুন — যাতে অন্য কেউ এ ফাঁদে না পড়ে।

সচেতন নাগরিক গড়তেই কাজ করছে বিবিধ ব্লগ, আমাদের সাথেই থাকুন।

One thought on “ঘরে বসে প্যাকিং এর কাজ — এক নতুন প্রতারণার জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *